ফিরকাতুল তাবলীগ (ফিরকা/দল + তাবলীগ/প্রচার)
“তাবলীগ” শব্দের অর্থ হলো পৌঁছে দেওয়া বা প্রচার করা।
কুরআনে এসেছে। وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ (৫:৯৯)
“রাসূলের দায়িত্ব তো কেবল পৌঁছে দেওয়া।”
অতএব, তাবলীগ মানে মূলত আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
তাবলীগ জামাতের আবির্ভাব
১৯২৭ সালে ভারতের সাহারানপুর অঞ্চলের আলেম মাওলানা ইলিয়াস কাঁদেলভী (রহ.) “তাবলীগ জামাত” প্রতিষ্ঠা করেন।
উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মুসলমানদেরকে নামাজ, মৌলিক ইবাদত, আখলাক ও দ্বীনের সহজ দাওয়াত দেওয়া।
তারা ছয়টি “উসূল” বা মূলনীতি গ্রহণ করে, যেমন:
১) কালিমা
২) সালাত
৩) ইলম ও যিকর
৪) ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানের সম্মান)
৫) ইখলাস (নিষ্ঠা)
৬) তাবলীগে সময় ব্যয় করা
ফিরকাতুল তাবলীগ: কেন একে “ফিরকা” বলা হয়?
“ফিরকা” অর্থ হলো দল বা উপদল। ইসলামী ইতিহাসে যেসব আন্দোলন বা সংগঠন মুসলিম সমাজে দাওয়াতের নামে আলাদা দল বা মতবাদে রূপ নেয়, তাদের অনেককে ফিরকা বলা হয়।
সময়ের সাথে সাথে এই জামাত একটি নির্দিষ্ট কাঠামোগত “দল” বা “মতবাদ”-এ পরিণত হয়।
তাদের জন্য কয়েকটি সমালোচনা উঠে আসে:
✅ তারা নিজেদের দাওয়াতি কার্যক্রমকে ইসলামের একমাত্র প্রকৃত দাওয়াত মনে করে বসা।
✅ শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ ইলম ছাড়াই সাধারণ মানুষকে দ্বীনের ব্যাপারে “ফতোয়া সদৃশ” কথা বলা।
✅ কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি না রেখে কেবল নিজেদের নির্ধারিত ছয়টি উসূলকে “মৌলিক দ্বীন” হিসেবে প্রচার করা।
✅ ইলম অর্জন, সামাজিক সংস্কার, অর্থনীতি বা শাসনব্যবস্থা সংস্কারের মতো কুরআনিক দায়িত্বগুলো উপেক্ষা করে কেবল ঘরে ঘরে গিয়ে নামাজের দাওয়াত দেওয়া।
মুসলিম সমাজে প্রভাব
ইতিবাচক দিক: অনেক গাফেল মুসলিমকে তারা মসজিদমুখী করেছে, নামাজে অভ্যস্ত করেছে।
নেতিবাচক দিক: ইসলামের পূর্ণাঙ্গ চেতনা (আকীদা, শরীয়ত, সামাজিক ন্যায়বিচার, কুরআনিক গভীর উপলব্ধি) থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল বাহ্যিক দাওয়াতের দিকে টেনে নিয়েছে।
ভেতরে ভেতরে বিভাজনও সৃষ্টি হয়েছে — বিশেষ করে তাবলীগ জামাতের দিল্লি কেন্দ্র আর রায়উইন্ড কেন্দ্র নিয়ে দ্বন্দ্ব, যা মুসলিম বিশ্বে দ্বিখণ্ডন ঘটিয়েছে।
কুরআন বারবার সতর্ক করেছে যেন মুসলমানরা ফিরকায় বিভক্ত না হয়:
“তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিভক্ত হয়ো না।”(৩:১০)
অতএব, যে কোনো সংগঠন, আন্দোলন বা দাওয়াত যদি আল্লাহর কিতাবের পূর্ণাঙ্গ আলোকে না চলে এবং আলাদা “ফিরকা”তে পরিণত হয়, তবে সেটি ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে যায়।
✅ ফিরকাতুল তাবলীগ মূলত তাবলীগ জামাত নামক আন্দোলনের এক ফিরকাভিত্তিক রূপ। তারা মুসলিম সমাজে আংশিক উপকার করলেও ইসলামকে খণ্ডিত দাওয়াতের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করেছে। কুরআন মুসলমানদের ফিরকাবাজি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবনবিধানকে আঁকড়ে ধরার আহ্বান জানিয়েছে।
১) কালিমা (لا إله إلا الله محمد رسول الله)
তাবলীগ জামাতের ধারণা: মানুষকে কালিমার দাওয়াত দেওয়া, ঈমান জাগ্রত করা।
সমালোচনা:
তাবলীগ জামাত এখানে কেবল শ্লোগানধর্মী কালিমা পাঠকেই গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ কুরআনে “কালিমা” মানে কেবল মুখে উচ্চারণ নয়, বরং পূর্ণ জীবনব্যবস্থায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন-হুকুম না মানা। (সূরা ইউসুফ ১২:৪০, সূরা মায়িদাহ ৫:৪৪–৫০)
সুতরাং তাদের দাওয়াত আংশিক মিল আছে, কিন্তু কুরআনের পূর্ণ তাওহীদ বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধ।
২) সালাত (নামাজ)
তাবলীগ জামাতের ধারণা: নামাজকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু করা।
সমালোচনা:
তাবলীগ জামাতের দাওয়াত প্রায় পুরোটা সালাতের দিকে সীমাবদ্ধ। অথচ কুরআন সালাতের পাশাপাশি যাকাত, ইনসাফ, জিহাদ, অর্থনীতি, পরিবার, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি—সবকিছুতেই আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে।
তারা সালাতকে জোর দিয়েছে, কিন্তু অন্য কুরআনিক দায়িত্বকে উপেক্ষা করেছে।
৩) ইলম ও যিকর
তাবলীগ জামাতের ধারণা: আল্লাহর স্মরণ, মজলিসে কিতাব পড়া, হালকা ইলম ও যিকর করা।
কুরআনের আলোকে:“যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?”(৩৯:৯)
সমালোচনা:
তাদের “ইলম” সাধারণত ফাযায়েলে আমল বা ছোট কিতাব পাঠের মধ্যে সীমিত থাকে। কুরআনের গভীর ইলম, শারীয়াহ, হিকমাহ, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান-দর্শন ইত্যাদি তারা উপেক্ষা করে।
কুরআনিক ইলমের ধারণা = বিস্তৃত ও সর্বাঙ্গীন। তাদের দাওয়াত = সীমিত ও আংশিক।
৪) ইকরামুল মুসলিমিন (মুসলমানের সম্মান)
তাবলীগ জামাতের ধারণা: মুসলিম ভাইদের প্রতি দয়া, সৌজন্য, সহানুভূতি।
সমালোচনা:
তাদের এই উসূল কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা হলো—তারা অমুসলিম সমাজ, সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্বলদের অধিকার, অর্থনৈতিক ইনসাফ—এসব কুরআনিক দায়িত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে না।
ফলে ইসলামের সার্বিক মানবিকতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল তাবলীগি গণ্ডীর ভেতর।
৫) ইখলাস (নিষ্ঠা)
তাবলীগ জামাতের ধারণা: দাওয়াত ও আমল শুধু আল্লাহর জন্য করতে হবে।
সমালোচনা:
এই উসূল সম্পূর্ণ কুরআনিক। তবে, বাস্তবে তাদের মাঝে অনেক সময় দলগত আনুগত্য (আমীর/শুরা/মারকাজের প্রতি অBlind loyalty) ইখলাসকে ক্ষুণ্ণ করে।
৬) তাবলীগে সময় ব্যয় করা
তাবলীগ জামাতের ধারণা: নির্দিষ্ট সময় (৩ দিন, ৪০ দিন, ৪ মাস) দ্বীনের কাজে বের হওয়া।
“তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল থাকুক, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে।”(৩:১০৪)
সমালোচনা:
কুরআনে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ নেই। দাওয়াত হলো পূর্ণ জীবনের দায়িত্ব। কিন্তু তারা এটিকে কার্যক্রমভিত্তিক সফর বানিয়ে ফেলেছে, যেন দাওয়াত শুধু ৩ দিন বা ৪০ দিনে সীমাবদ্ধ। এর ফলে দাওয়াত হয়ে যায় ritualistic, অথচ কুরআনে এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যাপী দায়িত্ব।
✅ সারকথা:
তাবলীগ জামাতের ছয় উসূল কুরআনিক ভিত্তি থেকে নেওয়া, তবে এগুলোকে পূর্ণ দ্বীন হিসেবে সীমাবদ্ধ করে তোলা, এবং কুরআনের বিস্তৃত দায়িত্ব (ইনসাফ, শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজ সংস্কার, জিহাদ) এড়িয়ে যাওয়া—এটাই তাদের প্রধান বিচ্যুতি।